Tuesday, April 28, 2015

মহাকবি ইকবাল

মহাকবি ইকবাল

ইকবালের শিক্ষার সবচেয়ে জরুরি দিক হচ্ছে, তিনি বর্তমান জগতের পরিবর্তন ধারার প্রতি মানুষকে সচেতন করে দিয়েই নিরস্ত হননি, উপরন্তু তিনি তাদের মনে জাগিয়ে দিয়েছেন আত্মসংরক্ষণের নবতর প্রেরণা। মানব-জীবনে আকাক্সা ও প্রেম সৃষ্টি করে তার আত্মাকে শক্তিমান করে তোলার প্রয়োজনের ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন

ইকবালকে কালাইলের ভাষায় 'Hero as a poet' বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। হোমারের রচনা যেমন একদিন গ্রিসের হৃতগৌরবকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল, ফেরদৌসী ইরানি বীরদের গৌরবগাথাও তেমনি বিধৃত করে গিয়েছিলেন তার অমর লেখনী দ্বারা। ইকবালের কাব্য সচেতন করে দিয়েছে মুসলিম জাহানকে বর্তমানের সঙ্ঘাত সম্পর্কে। গ্যাটে আর শীলার যেমন নবজীবন সঞ্চার করেছেন তাদের দেশের বুকে, রুশো ও ভলটেয়ার যেমন ফ্রান্সে এনেছেন নতুন যুগ, টলস্টয় ও গোর্কির রচনা যেমন তাদের দেশকে দিয়ে গেছে নতুন চিন্তাধারার উত্তরাধিকার, ইকবালের কাব্যও তেমনি একটা গতিশীল পরিবর্তন এনে দিয়েছে তার স্বসমাজে।
ইকবালের কাব্য প্রধানত দার্শনিক তত্ত্বপ্রধান। ধর্ম, জাতি ও সভ্যতা, শাসনব্যবস্থা, নারী-প্রগতি, সাহিত্য ও কলা এবং বিশ্বরাজনীতি সব কিছুই কবির অন্তরকে আকর্ষণ করেছিল সমভাবে। সাধারণভাবে মানবের পরিণতির প্রতিই তার দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। ইসলামের প্রতি তার বিশেষ মনোযোগ তাকে সত্যিকারভাবে ইসলামি রেনেসাঁর কবি করে তুলেছিল।
ইকবাল পূর্ণোদ্যমে আত্মনিয়োগ করলেন ইসলামের পুনরুজ্জীবনের কাজে। এ দিক দিয়ে তিনি যা করে গেছেন, তা চিরকাল ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে থাকবে।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম আধিপত্য লোপ পেল। রাষ্ট্রক্ষমতার অভাব ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনপদ্ধতি হিসেবে ইসলাম তার মর্যাদা অনেকখানি হারিয়ে ফেলল এবং মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন সামাজিক কার্যকলাপের সব ক্ষেত্রে আনল গুরুতর বিপর্যয়। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলো ক্রমাগত জটিল ও সঙ্কটময় হয়ে উঠল। অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিলুপ্ত জাতীয় চিন্তাধারায়ও বিপর্যয় সৃষ্টি করল। এই মর্মান্তিক বিয়োগান্ত পরিস্থিতির মধ্যে জন্মলাভ করল সামাজিক ও রাজনৈতিক সাহিত্য। অতীতের পুনরুজ্জীবনই হলো তখন কবি মনের একমাত্র লক্ষ্য। এই আত্মচেতনার মনোভাবের সাথে এলো আধুনিক চিন্তাধারার প্রভাব নিয়ে এক নতুনতর রেনেসাঁর যুগ। উর্দু সাহিত্যে হালি ও আকবর দিয়ে গেলেন এক অমূল্য অবদান; কিন্তু চার দিকের অন্ধকারাচ্ছন্ন পারিপার্শ্বিকের ভেতর দিয়ে জাতির সঠিক পথনির্দেশের কর্তব্যভার গ্রহণ করলেন আল্লামা ইকবাল।
তরুণ ইকবালের ইসলামি ভাবধারায় সমৃদ্ধ কবিতাবলি জাতীয় জীবনে আনল এক অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য। কবির বিশ্ববিশ্রুত দার্শনিক কাব্য ‘আসরার’ ও ‘রামুর’ মুসলিম সমাজে বয়ে আনল এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের সূচনা। ইসলামি জীবনধারা যখন অবনতিমুখী, ধর্মীয় অনুপ্রেরণা যখন জাতির মনে সাড়া জাগায় না, তখন এক নতুনতর নৈতিক সমর্থনের উৎস রচনা করল আল্লামা ইকবালের বাণী।
আধুনিক সভ্যতা ও চিন্তাধারার অনুপ্রবেশের সাথে সাথে নতুন সমস্যাগুলোর উদ্ভব হলো। প্রাচ্য সভ্যতার প্রভাব তখন ক্রমক্ষয়িষ্ণু দেশের যুবসমাজ হয়ে উঠল ধর্মবিমুখ। ইকবাল  এক দিকে ছিলেন ইসলামি চিন্তাধারার সাথে সুপরিচিত, অপর দিকে তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন পাশ্চাত্য ধারায়, তাই মুসলিম সমাজের পথনির্দেশের জন্য তিনি এগিয়ে এলেন নির্ভরযোগ্য রাহবার হয়ে। ইসলামি চিন্তাধারার বর্তমান পুনরুজ্জীবনের জন্য মুসলিম সমাজ তার কাছে বহুলাংশে ঋণী।
বিলাতে অবস্থানকালে ইকবাল ছিলেন প্যান-ইসলামি সোসাইটির সদস্য। ইসলামের সম্মুখে উদ্ভূত সমস্যাগুলোর আন্তর্জাতিক দিক নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন গভীরভাবে। ইসলামি বিষয় নিয়ে কবি এই সময়ে যেসব বক্তৃতা করছিলেন এবং পাশ্চাত্য মনীষীদের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি যেসব মন্তব্য করতেন তাতে ইসলামের আন্তর্জাতিক সমস্যার প্রতি কবির গভীর মনোযোগের পরিচয় পাওয়া যায়।
ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর কবি যখন সবে আইন ব্যবসায় শুরু করছেন তখন তুর্কি জাতি ত্রিপোলি ও বলকান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। আরব রাষ্ট্রগুলো তখন আন্তর্জাতিক কূটনীতিক প্রভাবে বিভ্রান্ত। তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের ফলে তুর্কি সাম্রাজ্যের পতন অবধারিত প্রায়। পাশ্চাত্য শক্তিপুঞ্জ তখন লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুরস্কের দিকে। তুর্কি জাতির প্রতি স্বাভাবিক সহানুভূতি পাক-ভারতীয় মুসলমানদের বিুব্ধ করে তুলল। ১৯১১ সালের ৬ অক্টোবর লাহোরের শাহি মসজিদে মুসলিম জনগণের এক বিরাট সভা হলো। এই ঐতিহাসিক সভায় ইকবাল আবৃত্তি করলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘খুনে পুহাদা কি নজর’। এই মর্মস্পর্শী কবিতা শ্রোতৃমণ্ড লীকে বিহ্বল করে তুলেছিল। মুসলিম দেশগুলো এক সাধারণ বিপদের সম্মুখীন, এই ছিল তখনকার মুসলমানদের এক সাধারণ ধারণা। ইকবালের সচেতন মন মুসলমানদের সামনে উপস্থিত বিপদের গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিল।
হজরত রাসূলে আকরাম মোহাম্মদ মোস্তফা সা:-কে লক্ষ্য করে কবি যে কবিতা লিখেছিলেন তাতে আমরা দেখতে পাই কবির দরদি মনের সুন্দর প্রতিচ্ছবি।
শান্তি নেই, হুযুর, এই দুনিয়ার বুকে,
মেলে না হেথায় বাঞ্ছিত জীবনের সন্ধান।
অস্তিত্বের বাগিচায় রয়েছে হাজারো লালা
হাজারো গুল,
নেই শুধু সেই কলি, ছড়িয়ে দেয় যে
ঈমানের খোশবু।
নজর এনেছি আমি এক পিয়ালা,
জান্নাতেও মিলবে না তার সন্ধান,
যে চিজ আছে এর ভিতরে।
দীপ্ত হয় এর ভিতরে তোমার উম্মতের মর্যাদা,
ত্রিপোলির শহীদানের লোহু
সঞ্চিত রয়েছে এর ভেতরে।
কবির মনে প্রেরণা সঞ্চার করেছিল ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল অতীত। তিনি তাদের পতনমুখী গতিতে গভীর উদ্বেগ বোধ করে তাদের শুনিয়েছেন বিজয়ী মুসলিম কাফেলার জয়গান।
ইসলামের এক সাধারণ লক্ষ্য মানবতার কল্যাণ সাধন। মানবসমাজকে বহুধা বিভক্ত করে বলেই উগ্র জাতীয়তাবাদকে (ঘধঃরড়হধষরংস) সমর্থন করে না ইসলাম। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের পরিণাম সম্পর্কে কবি মুসলমানদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে তাদের আহ্বান করেছেন বিশ্বমানবতার পথে। এক দিন যে কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দু¯ঁÍা হামারা’ সেই কবিই হয়ে উঠলেন, সারা জাহানের নাগরিক। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো বিশ্বমানবতার নতুন সুর।
‘চীন ও আরব হামারা, হিন্দুস্তাঁ হামারা;
মুসলিম হায় হাম ওয়াতন হ্যায় সারা
জাহাঁ হামারা।
‘শিকওয়া’ ও ‘জওয়াবে শিকওয়া’ নামে দু’টি জনপ্রিয় কবিতায় কবি মুসলিম সমাজকে এক নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তাদের সমাজ-সংস্কার উৎসাহিত করেছেন। সংস্কারক হিসেবে কবি তাতে যে প্রেরণা সঞ্চার করার চেষ্টা করেছেন তা নিঃসন্দেহে বাঞ্ছিত ফল প্রসব করেছে। শিকওয়ার কবি খোদাকে লক্ষ্য করে জানিয়েছেন তার অন্তরের ফরিয়াদ মুসলিম জাতির বর্তমান দুরবস্থার জন্য।
‘জীবন ভরি’ যারা তোমার প্রশংসারই পড়লো নামায,
তাদের মুখের কুৎসা খানিক নাও না শুনে’ রাজাধিরাজ।’
মুসলিম জাতির দুঃখ-দুর্দশা বর্ণনা করে কবি বলেন।
নেভার আগে প্রদীপ যথা মরণ ভয়ে কম্পমান,
তেমনি এ ক্ষীণ প্রাণের মাঝে কাঁপছে আমার ক্ষীণ ঈমান।
বেঁচে থাকার সার্থকতা আগেই গেছে সব ঘুচে,
বাদ ছিল সে চিহ্নটুকু যায় বুঝি আজ তাও মুছে।
‘জাওয়াবে শিকওয়া’ কবিতায় খোদা মুসলমানদের অভিযোগের জওয়াব দিয়ে বলেছেন।
‘আজ সুকঠোর জাগরণ তব নব প্রভাতের তীরে
আজ তুমি ভালোবাস না আমারে ভালোবাস সুপ্তিরে।
রমযান মাসে রোযার বিধানে দেখ আজ কঠোরতা,
বলো বলো তবে এই কি তোমার প্রেমের একাগ্রতা?
দৃঢ় বিশ্বাস বৃত্তের পরে জাগে কওমের মন,
আসমানে তারা নাহি জাগে যদি না থাকে আকর্ষণ।’
‘মসজিদে শুধু আসে গরীবেরা মোর,
সহিয়েছে গরীব সিয়ামের তৃষ্ণা ঘোর,
শুধু গরীবেরা নেয় যে আমার নাম,
বাঁচায় সে আজো পর্দা তোমার পুরায় মনস্কাম,
মাতাল ধনিক ঐশ্বর্যের ডোরে
মত্ত নেশায় ভুলিয়া গিয়াছে মোরে।’
‘জওয়াবে শিকওয়া’য় কবি দেখিয়েছেন মুসলিম জাতির বর্তমানের রূপ; তাদের গাফলতি, তাদের নিষ্ক্রিয়তা, তাদের ধর্মবিমুখতা ও ঈমানের কমজোরি তাদের টেনে দিয়েছে পতনের পথে, তাই তারা হারিয়েছে তাদের গৌরবময় ঐতিহ্য। তারপরই কবি খোদার জবানে তাদের শুনাচ্ছেন আশার বাণী :
‘জ্ঞানের ধর্ম দিয়েছি তোমারে, প্রেম তব তরবারি,
মোর দরবেশ লই খিলাফত হও সুযোগ্য তারি।
আগুনের মতো প্রোজ্বল হয়ে জাগবে ও তকবীর
হও মুসলিম তদবীর তব জানি হবে তকবীর।
তুমি যদি হও মুহম্মদের প্রেমিক, আমিও তবে তোমার প্রেমিক হবো
দুনিয়া, তো ছোট লওহ কলম দেবো আমি তোমাকেই;
চিরদিন আমি তোমার প্রেমিক রবো।
ইকবালের বাণীর একটা বিশেষ আবেদন রয়েছে যুবরাজের কাছে, যারা হারিয়ে ফেলেছে তাদের পূর্ব পুরুষের অনুসৃত পথ এবং বর্তমান শক্তিমান জাতিগুলোর মহৎ গুণরাজির অস্তিত্বেও নেই যাদের ভেতর।
কবি তবু আশা হারাননি। তার চোখে ভেসে উঠেছে অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন, অন্ধকারে নিশার অবসানে পূর্বাশার আলোক রশ্মি :
তারকারাজির ম্লান আভা/ দীপ্ত প্রভাতের নিদর্শন,
সূর্য উদিত হলো দিগন্তে/ অতীত হলো সুখ স্বপ্নের কাল।
কবি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন ধর্মের পথে। জাতিকে তিনি বুঝিয়েছেন যে, বিঘœ-সঙ্কুল পথ অতিক্রম করে চলাই সত্যিকার জীবন :
গ্রহণ করো না তোমার জীবিকা/ অপরের হাত থেকে
সৎ হও তুমি/ গ্রহণ করো সজ্জনের নির্দেশ।
ইকবালের শিক্ষার সবচেয়ে জরুরি দিক হচ্ছে, তিনি বর্তমান জগতের পরিবর্তন ধারার প্রতি মানুষকে সচেতন করে দিয়েই নিরস্ত হননি, উপরন্তু তিনি তাদের মনে জাগিয়ে দিয়েছেন আত্মসংরক্ষণের নবতর প্রেরণা। মানব-জীবনে আকাক্সা ও প্রেম সৃষ্টি করে তার আত্মাকে শক্তিমান করে তোলার প্রয়োজনের ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন সবচেয়ে বেশি। তার শিক্ষার সুষ্ঠু প্রভাব চেতনা সঞ্চার করেছে মুসলিম জাহানের বুকে :
পয়দা করে তোল এক সচেতন আত্মা
কারণ আত্মা থাকে যতোদিন ঘুমন্ত,
তোমার আঘাত লাগে না কাজে,
আমার আঘাত-ও নয়।
জাতির অন্তরে উচ্চ নীতিবোধ জাগিয়ে দেয়ার জন্য তিনি উচ্চ মানসিকতার সাথে সাথে
‘ফকর’কে দিয়েছেন বিশেষ গুরুত্ব :
সেই ফকির হচ্ছে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ
দারা ও সিকান্দারের চেয়ে;
জীবনে যার সঞ্চিত রয়েছে
আসাদুল্লার মহত্ত সৌরভ।
চল্লিশের আলোয় বাংলা কবিতা
মাঈন উদ্দিন জাহেদ
আপন স্বভাবে হঠাৎ যখন থমকে দাঁড়াই সবুজে সমারোহে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবি এ দেশের নাগরিক বলে। এত বিশালতায় যাদের অবস্থান, এত নান্দনিকতায় যাদের ভুবন, এত রসময় নির্মাণ যে জনগোষ্ঠীর সৃজনময়তা, তাদের একজন হয়ে মাঝে মাঝে ভাবিÑ এ দেশ কখন শিল্প-সাহিত্যের দ্বিতীয় তীর্থ ভূমি হিসেবে দাঁড়াবে। প্রথম তো হয়ে আছে প্যারিস। লোকসাহিত্য ও শিল্পে এবং সমস্ত সৃজনশীল নান্দনিক নির্মাণে শিল্পীরা যে আপন বৌদ্ধিকতার স্বকীয়তা রেখে গেছে তা বিশ্বশিল্প ও সাহিত্যের প্রোপটে সম্পূর্ণ আলাদা এবং ঐশ্বর্যময়। এ ঐশ্বর্য বিশ্বজয়ের জন্য যে নাগরিক উদ্যোগের প্রয়োজন, তা নিয়ে ভাবছেন না ভোক্তাশ্রেণী। এই ভোক্তা-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কথা উঠলেই মনটা হু হু করে ওঠে। পুরো পৃথিবীর বেনিফিশিয়ারি গ্রুপটাই এরকম কি না? তা জানতে ইচ্ছে করে। এই নাগরিক সুবিধাবাদীই আজ বাংলাদেশের সমস্যা, সাহিত্যের সমস্যা, দ্রোহের সমস্যা, কর্মের সমস্যা, গড়ার সমস্যা, ভাঙার সমস্যা। বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস, নাটকের ইতিহাস, গল্পের ইতিহাস উপন্যাসের ইতিহাস, প্রবন্ধের ইতিহাস নির্মাণে বিভ্রান্তি ও বিতণ্ডার ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে এ নাগরিক মধ্যবিত্ত। অথচ এ সুবিধাবাদী শ্রেণী না পেরেছে নিজেদের নাগরিক উৎকর্ষে উপস্থাপিত করতে, না পারছে গ্রামীণ স্বকর্যে আত্মস্থ করতে। এক হীনম্মন্য আত্মদ্বন্দ্বে ভুগে ভুগে ‘সুবিধাবাদের তৈলচিত্র’ নির্মাণ করে যাচ্ছে নিয়ত। পারছে না নাগরিক যন্ত্রণাকে আত্মস্থ করতে শিল্পের স্বমহিমায়, পারছে না বাংলার আত্মস্বভাবে শিল্পের আপন স্বভাব নির্মাণ করতে। এক জটিল সমীকরণে শুধু গোঁজামিলের আশ্রয়ে, বেড়ে উঠছে মধ্যবিত্ত নগরগুলো। তাই তাদের সাহিত্য, শিল্প, নাটক, উপন্যাস, গল্প- এমনকি কীটপতঙ্গ শ্যাওলার। বাধ্য হয়ে বৈয়াকরণিক বৈধতায় তাকেও পঙ্কজ বলছি আমরা। বেনিয়াদের সৃষ্ট মধ্যবিত্ত আজ য়ে য়ে সমাজের বোধগুলো ভাঙছে। কেদের জন্ম দিচ্ছে, প্রগতির উন্নাসিকতায় হারাচ্ছে মূল্যায়নের মানদণ্ড। ইউরোপের কাছে বা যৌক্তিকতা যুক্তিহীনতা না বুঝে অনুকরণের বন্যায় বুদ্ধিজীবী সেজে যাচ্ছে অরজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক সমাজের। আমি ইচ্ছে করে শিতিসমাজ শব্দটি ব্যবহার করলাম না। কারণ এ শ্রেণীকে কিভাবে শিতি বলব? যারা শিার নামে মুখস্থবিদ্যা জাহির করছে। বৌদ্ধিকতার ন্যূনতম চর্চা যেখানে নেই, তারা কিভাবে শিতি হয়? আমার বোধগম্য হয় না। শুধু বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস মূল্যায়নের দিকে দৃষ্টি ফেরালে, এদের মূল্যায়নের তলানিটা বোঝা যাবে। যেখানে যুক্তি নয়, বোধ নয়, ইতিহাসের অনিবার্য প্রসঙ্গ নয়, কাজ করে শুধু রাজনৈতিক আনুগত্যের মুদ্রার সৌকর্য।
হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করেছেন এর কালক্রম। এই যে কাল বিভাজন তাকে মূল্যায়ন করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠেÑ তারা ইতিহাসের বাস্তবতায় সময়কে চিহ্নিত করেছেন। রাজনৈতিক সময়সীমা বা সমাজগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণের কাল পরিধিকে সাহিত্যের সময় নির্ধারণে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। কারণ একটি জনগোষ্ঠীর সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্প তার সমাজব্যবস্থার পটভূমিতেই বেড়ে ওঠে। যতই নান্দনিক বা শৈল্পিক উত্তুঙ্গ চূড়াকে স্পর্শ করুক, তা কখনো সময়ের চিহ্নকে অতিক্রম করতে পারে না। তাই মহাকবি গ্যাটে সত্যি বলেছিলেন ‘রাজনীতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি বিবেচ্য শক্তি। রাজনৈতিক উত্থানপতন বিশেষ করে আধুনিক রাষ্ট্রে একটি জনগোষ্ঠীর ভাগ্য নির্ধারণ করে।’ 
১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশের জনগোষ্ঠীর ভাগ্য নির্ধারণ করেছে রাজনীতিই। তাই সাহিত্যের পালাবদল কিংবা শৈলীবদল, যাই ঘটুক তা সমাজচিত্রের অনিবার্য প্রসঙ্গকে এড়িয়ে সম্ভব নয়। প্রসঙ্গটা উত্থাপিত হলো এ জন্য- সম্প্রতি কোনো মহলকে সুকৌশলে বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস ’৫২ পরবর্তী অর্থাৎ পঞ্চাশের দিকে মুখ্য করে তুলেছে। এটা এক ধরনের মূর্খতা কিংবা একে অতি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রয়াস ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। কারণ বাংলাদেশের সাহিত্য বিবেচনায় চল্লিশের দশক এবং সত্তরের দশক একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ইতিহাস নির্মাণে এই দুই দশককে আলোচনা ছাড়া বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্যে চল্লিশের দশক উপেতি। বিশেষ করে চল্লিশের দুই প্রধান কবি ফররুখ আহমদ ও আহসান হাবীবের অনুপস্থিতি, আবুল হোসেনের নেপথ্য চারণ, সৈয়দ আলী আহসানের রাজনৈতিক কূটজালে আটকে যাওয়াই এ দশক আলোচনার পাদপ্রদীপে আসতে সম হয়নি। এ ছাড়া, বিশেষ করে পঞ্চাশের কবিরা চাননি তাদের জীবিতকালে চল্লিশের দশক প্রাধান্য লাভ করুক। এতে নিজেদের অবস্থান ঠুনকো হয়ে যায় এবং চল্লিশের দশকে বাংলা কবিতায় একটি বলিষ্ঠ ধারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চৈতন্যকে ধারণ করে গড়ে উঠে তার বিস্তার লাভ করুক। তাই পঞ্চাশের কবিরা তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের পরিচর্যা করতে গিয়ে সাহিত্যের মর্যাদাবোধ উপো করেছেন এবং সাহিত্যচর্চায়- গদ্যের যাত্রায়- নিজেদের প্রধান করে তুলেছেন। অগ্রজদের উত্তরাধিকারকে ধারণ করে নিজেদের বিস্তৃত করেছেন কিন্তু কৃতজ্ঞতার পরিচয় দেননি। এমন কি তাদের সাহিত্যিক সততার ব্যপারেও প্রশ্ন তোলা যাবে।
বাংলাদেশের কবিতা বিবেচনায় কেন চল্লিশের দশক অনিবার্য প্রশ্ন তুললে, বলতেই হয় তার অর্জনের কথা। ঊনবিংশ শতাব্দীর নবচেতনায় স্নাত হয়ে যখন কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী সমাজ বাংলা সাহিত্যের এককেন্দ্রিক ইতিহাস সৃষ্টি করে সাহিত্য সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সাহিত্যের প্রবল উত্তরাধিকার মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজ উদার মানবতবাদী জীবনাদর্শ মানবিক আহ্বানকে শিল্পীত উপস্থাপনের বাস্তব পদপে হিসেবে বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চার প্রয়াস চালান এ চল্লিশের দশকে। বৃহৎ ভাটি বাংলার জনগোষ্ঠীর জীবনচর্যা সাহিত্যের পদবাচ্য ছিল না এর পূর্বে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক প্রয়াসে। উচ্চবিত্ত হিন্দু সমাজের জীবনাচরণকে একমাত্র মান্য রুচি হিসেবে উপস্থাপন চলছিল বাংলা সাহিত্যে। বাঙালি মুসলমানদের একান্ত সাংস্কৃতিক চর্চা ফুটে ওঠে চল্লিশের শব্দ শিল্পীদের হাতে এই ভাটি বাংলায়। তাই বাংলা সাহিত্যে চল্লিশের দশক অনিবার্য ভিন্ন মাত্রার প্রসঙ্গ। বাংলা কাব্যে চল্লিশের দশকে ভিন্নযাত্রা না হলে বাংলাদেশ অঞ্চলের সাহিত্যিকদের সততার প্রশ্ন তোলা যেতো এবং অনিবার্যভাবে বাংলা কবিতা যাত্রা রুদ্ধ হতো। তার যথার্থ উদাহরণ আজকে পশ্চিম বাংলার কবিতার শৈল্পিক প্রসঙ্গকে টেনে আনা যায় এবং পঞ্চাশের কবি সুনীলের বিবেচনা ‘বাংলাদেশের কবিতা পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক উন্নত’কে প্রসঙ্গে ধার করা যায়। বাংলাদেশের কবিতা অনিবার্যভাবে চল্লিশেরই স্বর্ণফসল। বাংলাদেশের কবিতার বিবেচনা অনিবার্যভাবে চল্লিশ থেকে শুরু করতে হবে। বাংলাদেশের কবিতা বিবেচনায় তার প্রথম যাত্রার লণ চিহ্নিত করতে গেলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তিনটি ধারা। এক. কবি ফররুখ আহমদ সৃষ্ট প্রবল আদর্শিক ধারা- দুই. প্রবল শিল্পনিষ্ঠ এবং চৈতন্য ধর্মনিরপে চেতনায় নিষ্ঠ বস্তুবাদী ধারা আবুল হোসেন একান্তভাবে চর্চা করে গেছেন। তিন. বাঙালি মুসলমানদের জীবন চর্চার স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত আত্মসচেতন ধারা যা সচেতনভাবে, স্পষ্টভাবে কবি আহসান হাবীব চর্চা করে গেছেন।
বাংলাদেশের কবিতা আলোচনা করতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবে এ তিন ধারাকে বিশ্লেষণ করতে হবে। বাংলাদেশের কবিতার পরবর্তী দশকগুলো এ তিন ধারারই সম্প্রসারিত ফসল, যা আশির দশক পর্যন্ত মোটামুটি বলয়পূর্ণ করেছে। কবি আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫) বাংলা কবিতায় যথার্থই নিয়ে এসেছিলেন পালাবদলের হাওয়া। তিরিশ সৃষ্ট কাব্য স্বভাব থেকে উড়িয়ে বাংলাদেশের কবিতায় তিনি দেশজ আবহ, শব্দ এবং অনুষঙ্গেও দেশজ মাত্রা যোগ করেছেন, যা সে সময়ে স্বাভাবিকভাবে কঠিন ছিল। তিরিশের কবিদের প্রচণ্ড প্রতাপে বাংলা কবিতায় যখন অগ্রজ অনুজ সবাই দলবেঁধে গ্রিক মিথ ও ইউরোপবাহী কবিতার অনুবাদে মত্ত, আহসান হাবীবের ভিন্নযাত্রা তার মনস্বী চেতনার প্রবল উত্তাপের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ সচেতনতা তার কাব্য গ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ (১৯৪৭) এর নাম থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শাসনের সমাপ্তিকে কবি রাত্রির অভিধা দেন। আঁধারের সমাপ্তির সাথে বিবেচনা করেছে শৈল্পিক নৈপুণ্যে। একে একে তার কাব্যগ্রন্থ, সারা দুপুর (১৯৬৪) ছায়া হরিণ (১৯৬২), আশায় বসতি (১৯৭৪), মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬)। তার কাব্য ভাব থেকে সমকালীন চেতনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার কবিতায়। চল্লিশের দশকে প্রকাশিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রি শেষ (১৯৪৭)কে বিবেচনায় আনলে কবি আহসান হাবীবের আত্মস্বভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চল্লিশের আহত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের হৃদয় আর্তিও সাথে কাব্যিক সমাজসচেতনা যোগ হয়েছে বাঙালি মুসলমান সমাজের তৎকালীন আত্মদ্বন্দ্ব। ভেতর-বাহিরের টানাপড়েনে ‘রাত্রিশেষে’র শৈল্পিক বিন্দুতে চিহ্নিত হয়েছে।
ভাটি বাংলার অসাধারণ লোকজ বাস্তবতা সাধারণ অথবা স্বহৃদয় উপস্থিতি অনেক সময় বিদগ্ধ পাঠককে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। অথচ এ আত্মস্বভাবে চিহ্নিত হয়ে যায় কবি আহসান হাবিবের প্রেরণা। তিরিশোত্তর বাংলা কবিতায় তিনি যে বাঙালি স্বভাব আনতে চেয়েছিলেন কবিতায় তা তার শব্দ ব্যবহারের দিকে ল রাখলে স্পষ্ট হয়। কবি আহসান হাবীবের কাব্য ভাষায় শব্দ ব্যবহারের আলাদা মাত্রা চিহ্নিত হয় তার তদ্ভব শব্দপ্রাচুর্যে। হঠাৎ করে বাংলা কাব্যে তদ্ভব শব্দের এ প্রয়োগের ঐতিহাসিকতা আছে। বাঙালি মুসলমানদের ভাষায় সঙ্কটময় মুহূর্তে শুধু বিভুঁই পাকিস্তানিদের প থেকে সৃষ্টি হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের আর্যকরণ চলছিল সেই ১৮০০ সাল থেকে, যার ফলে ভাষায় একটি সাংস্কৃতিক-সামাজিক পরিবেশ লোপ পাচ্ছিল এ বৈদিক ষড়যন্ত্রে, বাঙালি মুসলমান ক্রমান্বয়ে এর থেকে মুক্তি চাচ্ছিল। রাজপথে লড়াই করে যা পাওয়া সম্ভব হয়েছে ’৫২ সালে তার চেয়ে কঠিন লড়াই ছিল ভাষা সংগঠনে। বাঙালি মুসলমানদের আত্মস্বভাবের প্রশ্নে এ সঙ্কট থেকে মুক্তির বৌদ্ধিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের শব্দশিল্পী আহসান হাবীব সেখানে- বাঙালি ও মুসলিম দুই পরিচয় উন্মোচন করেছিল তার কাব্য ভাষায় নিজের আন্তর্জাতিক উত্তরাধিকারকে অস্বীকার না করে।

0 comments:

Post a Comment