Tuesday, April 28, 2015

আব্দুল্লাহ উপন্যাসের স্রষ্টা কাজী ইমদাদুল হক

আব্দুল্লাহ উপন্যাসের স্রষ্টা কাজী ইমদাদুল হক

ইমদাদুল হকের মধ্যে ছিল জীবনকে যথাযথভাবে দেখার তন্ময় অনুধাবন। তার আব্দুল্লাহ (১৯১৮) আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। আজ থেকে ১০০ বছর আগে বাঙালি মুসলমান সমাজ কেমন ছিল এই উপন্যাস পড়ে আমরা তা জানতে পারি
আলোকিত সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক। ১৮৮২ সালের ৪ নভেম্বর খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও প্রথম জীবন কাটে খুলনা শহরে। পিতার নাম কাজী আতাউল হক। তিনি আসামের জরিপ বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।

 ইমদাদুল হক মুসলিম সমাজের নানা ত্র“টি সহানুভূতির সাথে অঙ্কিত করেছেন। ইমদাদুল হকের মধ্যে ছিল জীবনকে যথাযথভাবে দেখার তন্ময় অনুধাবন। তার আব্দুল্লাহ (১৯১৮) আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। আজ থেকে ১০০ বছর আগে বাঙালি মুসলমানসমাজ কেমন ছিল এই উপন্যাস পড়ে আমরা তা জানতে পারি। উপন্যাস অনেক ধরনের হয়। একধরনের নিছক একটি কাহিনী বলে আমাদের আনন্দ দেয়। পাঠককে কেবল আনন্দ দেয়া ছাড়া লেখকের বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। আরেক ধরনের উপন্যাসে লেখক সচেতনভাবে একটি বিশেষ সময় ও সমাজের ছবি আঁকেন। সেই সমাজের মানুষ কেমন ছিল, কী ছিল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এসব পাওয়া যায় এ ধরনের উপন্যাসে। ‘আব্দুল্লাহ’ এমনি একটি উপন্যাস। এই সে দিনও বাঙালি মুসলমানসমাজে প্রবলভাবে বিরাজ করছিল আধুনিক শিক্ষার অভাব, নানা কুসংস্কার, ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামি, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ঘোর হতাশা। আব্দুল্লাহ উপন্যাসে সেই ছবিটি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তবে দুঃখজনক পরিস্থিতিতেও আব্দুল্লাহর মতো মুক্তমনের মানুষও যে জন্ম নেয়, সেটাও লেখকের চোখে পড়েছে। আসলে মুক্তমনের মানুষেরা যুগে যুগে সমাজে পরিবর্তন এনে থাকে। এদের জন্যই সমাজ অন্ধকার থেকে আলোতে পৌঁছে।
১৯০৪ সালে কলকাতা মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯১১ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভূগোলের শিক্ষক নিযুক্ত হন। এখানে শিক্ষকতা করার সময় বিটি পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন্সপেক্টর অব স্কুলস ফর মোহামেডান এডুকেশন। ১৯১৭ সালে কলকাতা টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের অধ্য নিযুক্ত হন। ১৯২১ সালে ঢাকা মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে তিনি সচিব নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এই পদে বহাল ছিলেন। কাজী ইমদাদুলের জীবন ও সাহিত্য অবিচ্ছেদ্য। জীবনে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তার সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। তৎকালীন মুসলিমসমাজে বিরাজমান সমস্যা নিপুণ শিল্পীর মতো সাহিত্য ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন। স্যার সৈয়দ আহম্মদ আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে মুসলিম সম্প্রদায়কে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে যুগোপযোপী করে তুলতে চেয়েছিলেন। মুসলিমসমাজকে আধুনিক ও উন্নত ব্যবস্থায় উন্নীত করতে চেয়েছিলেন। কাজী ইমদাদুল হকের প্রথম উপন্যাস আব্দুল্লাহ (১৯১৮) প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সাহিত্য জগতে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আব্দুল্লাহ উপন্যাস পাঠে কাজী ইমদাদুল হকের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বচ্ছ মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। সমাজের উঁচু-নীচু ভেদাভেদ ও কৃসংস্কার দূর করে মুসলিমসমাজকে জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে মুরব্বির মতো এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি পুরনো ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে সংস্কারপন্থী নতুন প্রজন্মকে মুখোমুখি দাঁড় করে পুরনোর দুর্গশিবিরে নতুনের বিজয় কেতন ওড়াতে চেয়েছেন।
কাজী ইমদাদুল হক ছাত্রজীবন থেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তার প্রথম সাহিত্যকর্ম ৯টি কবিতাসংবলিত ‘আঁখিজল’ প্রকাশিত হয় ১৯০০ সালে। মাদরাসায় শিক্ষকতা করার সময় তার লেখা ‘ভূগোল শিক্ষা প্রণালী’ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। ১৯০৪ সালে মুসলিম জগতে বিজ্ঞানচর্চা ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯১৭ সালে নবী কাহিনী এই যুগের শিশুসাহিত্যে লেখকের অমর অবদান। ১৯১৮ সালে দুই খণ্ডে তার প্রবন্ধলিপি প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধমালা বইয়ে ‘আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন পুস্তকাগার, আব্দুর রহমানের কীর্তি, ফ্রান্সে মুসলিম অধিকার, আলহামরা মুসলিম জগতের বিজ্ঞান চর্চা দেখা যায়। এ সময় তিনি আব্দুল্লাহ উপন্যাস শুরু করেন। ৩০টি পরিচ্ছেদ লিখে তিনি পাণ্ডুলিপিটি ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য দেন এবং এগুলো ওই পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এরপর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। অবশিষ্ট ১১টি পরিচ্ছেদ তার মৃত্যুর পর খসড়া অবলম্বনে তার বন্ধু কাজী আনারুল কাদির লিখে শেষ করেন। ১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড আব্দুল কাদিরের সম্পাদনায় প্রকাশ করে ‘কাজী ইমদাদুল হকের রচনাবলী’।
কাজী ইমদাদুল হকের ভাষা সরল ও প্রসাদগুণমণ্ডিত। ইমদাদুল হকের জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী আনারুল হক আমলা, টেকনোক্র্যাট উপদেষ্টা, মন্ত্রী লেখক। কাজী আনারুল হক অবসরগ্রহণের পর তিনি স্মৃতিকথা রচনা করেন। ‘রেসিনিসিন্স অব পাবলিক সারভেন্ট’ তার দেখা বিভিন্ন সময় ঘটনার বিবরণ। আনারুল ছিলেন কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থার একজন উৎসাহী সমর্থক। এমনকি অবসর গ্রহণের পরও পুলিশ বাহিনীর দতা বৃদ্ধি এবং তাদের কল্যাণের ব্যাপারে খুব মনোযোগী ছিলেন। কাজী ইমদাদুল হক বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (১৯২০) প্রকাশনা কমিটির সভাপতি ছিলেন।
শিক্ষা বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ১৯২১ সালে খান সাহেব এবং ১৯২৬ সালে খান বাহাদুর উপাধিতে সম্মানিত করেন। কাজী ইমদাদুল হকের জীবনাদর্শ ও সাহিত্য দর্শন অবশ্যই দিকনির্দেশক হতে পারে। অসম্ভবকে সম্ভব করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মহিমায় উদার মানবতাবোধ, দেশপ্রেম ও সমাজকল্যাণের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তার সাহিত্য পরিষেবা বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের জন্যও পাথেয় হয়ে থাকবে।
আলোকিত সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন ১৯২৬ সালের ২০ মার্চ। তিনি ছিলেন আমাদের সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি আজীবন সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি। আমরা তাকে স্মরণ করব আজীবন বিনম্র শ্রদ্ধায়।

0 comments:

Post a Comment